মানুষের মানচিত্র- রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

আহারে বৃষ্টির রাত, সোহাগী লো, আমি থাকি দূর পরবাসে।
কান্দে না তোমার বুকে এক ঝাঁক বুনো পাখি অবুঝ কৈতর?
কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে বা কাটাও প্রহর?
পরান ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস দারুন বৃষ্টির মাসে।

যে বলে সে বলে কথা,কাছে বসে, হাতে খিলিপান দিয়ে কয়-
এতো জল ঝরে তবু পরান ভেজে না কেন, কওতো মরদ?
দুয়ারে লাগায়ে খিল যদি কেউ থাকে তারে কে দেবে দরোদ!
শরীরের মোহনায় দেখি তার বুনো ঢেউ রক্ত-মাংশময়।

শরীর গুটায়ে রাখি,শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতরে।
অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে,
আমি বলি-ক্ষমা দাও,পরান বন্ধুয়া মোর থাকে পরবাসে,
দেহের রেকাবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে!

গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেল তা-ও নামে না বাদল,
এবার জোষ্টিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল জোয়াল।
আমাদের মাঝে দ্যাখো জমির ভাগের মতো কতো-শত-আল,
এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদোল

কবে পাবো? কবে পাবো আলহীন একখন্ড মানব-জমিন?
পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।
মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বনের তিথি কবে পাবো?
কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন।।

কবিতা: মানুষের মানচিত্র-১

২.
পাখির নাহান ডাকো । মাঝরাতে ডাক দাও পাখির গলায় আমি কি বুঝি না ভাবো?
কাতলা মাছের মতো ঘাই মারে বুকে, ওই ডাক ঘাই মারে রক্তে-মাংশে।
ভাবো ঘরে আছি সুখে। আহারে পোড়ার সুখ- তুফানের গাঙ দেখে মাঝি সে পালায়।

বুড়ো ভাতারের ঘর কোন সুখে করি তুমি বোঝো না নাগর?
পাখির নাহান শুধু ডাক পাড়ো মাঝরাতে ঘরের কিনারে।
হাঁপানির চোট খুব গরম তেলের জাব দিতে হয় তারে,
আমার হাঁপানি থাকে বুকের তুষের নিচে অনল-সাগর।

সারাদিন রান্নাঘরে। একপাল পোলাপান তাদের যতন।
আর তিন বউ তারা দিন-রাত পান খেয়ে মুখে দেয় শান।
তাদের শানানো কথা গতর জ্বালায়ে ছাড়ে, জ্বালায় পরান।
আহারে পোড়ার সুখ! দিন কাটে, রাত তা-ও দিনের মতোন-

রাত্তির কাটে না আর। দেহের আগুন নেভে, পরান নেভে না।
কোনদিন শখ হলে কাটা ঘায়ে ফের তিনি ছিটান লবন,
 দিনভর দেহ জ্বলে, সারারাত জ্বলে এই নওল যৈবন।
 পোড়ার জীবন নেবে, পোড়া-কপালিরে তবু মরন নেবে না…
পাখির নাহান কেন ডাক দাও নিশিরাতে?
বিহান বেলায় যদি পারো ডাক দিও,
ডাক দিও রোদ্দুরের তাতানো দুপুরে,
কেমন ছিঁড়তে পারি শিকলের শিক দেখো জীবন-নূপুরে গান তুলে
কেমন আসতে পারি স্বপ্ন-ধোয়া হৃদয় তলায়।।

০৮.০২.১৩৮৮ মিঠেখালি মোংলা

৩.
মেম্বারের ছেলে দুটো ইশকুলে পড়ে,আমার হাঁড়িতে টান।
বেশুমার দায় দেনা, খাওয়াইয়া সাতজন,পঙ্গু বাপ ঘরে,
বেজাত আকাল যেন ঝাপায়ে পড়েছে এসে জীবনের ‘পরে।
এতো যে সেয়ানা মাঝি, আমার নদীতে তবু বেজায় উজান।

আমি গাঙে নাও দিলে সব নাও পাছে পড়ে উজানে কি গোনে,
আমার জীবন-নাও সবার পেছনে কেন তবু প’ড়ে রবে?
পশরের গাঙে এক তুখোর জোয়ান মাঝি এই কথা ভাবে।
চারপাশে অন্ধকার, সে তার বুকের ক্ষেতে এই প্রশ্ন বোনে।

রাত্রির গভীর হয়, তুফানের শব্দ বাড়ে, জলে জ্বলে নুন,
দিনের রোদ্দুরে পোড়া তাতানো গতর থেকে গন্ধ আসে তার।
জীবনের চাদ্দিকে হাতড়ায় মাঝি- আলো নেই, শুধু অন্ধকার,
কাঞ্চা বাঁশের নাহান জোয়ান শরীরে তার ধ’রে গেছে ঘুন!

জলের সংসারে ভাসে তবু তো শিকড় তার রয়েছে মাটিতে,
তবু তো শিকড় তার রয়েছে জীবনে,
জীবনের পুষ্টিহীন উষর মাটিতে আজো,
আজো মাঝি শুধে যায় জীবনের ঋন।
 জোয়ারের নাওখানি বার বার কাঁপে তার দুখের ভাটিতে।

রাত তো পোহায়ে এলো, লগি খুলে স্রোতে দিতে হবে নাওখান,
আমার রজনী কবে পোহাবে দয়াল,
ভাঙা নাওখানি কবে গোনে বা বেগোন স্রোতে জীবনের মত্ত গাঙে একধারা ব’বে!
এ-প্রশ্নের চারা হবে সে কোন অঘ্রানে তার উত্তরের ধান?

০৯.০২.১৩৮৮ মিঠেখালি মোংলা

৪.
ভাসান যে দিতে চাও, কোন দেশে যাবা?
যাবা সে কোন বন্দরে আমারে একেলা থুয়ে?
এই ঘর যৈবনের কে দেবে পাহারা?
এমন কদম ফুল- ফোটা-ফুল থুয়ে কেউ পরবাসে যায়!
তুমি কেন যেতে চাও বুঝি সব, তবু এই পরান মানে না।

লোকে কয় ভিন দেশে মেয়ে মানুষেরা নাকি বেজায় বেহায়া,
শরীরের মন্ত্র দিয়ে আটকায় শাদা-সিদে পুরুষ মানুষ।
 তোমারে না হারাই যেন সেই দিব্যি দিয়ে যাও জলের কসম,
আর বলি মাস মাস খোরাকি পাঠাতে যেন হয় নাকো দেরি।

পুবের না পশ্চিমের দেশ,কোন দেশে যাবা মাঝি, কোন দেশ?
সেখানে কেমন জানি লোকজন, মানুষের আচার বিচার!
শুনেছি দক্ষিনে ভয়, আজদাহা দরিয়ার বেশুমার খিদে,
পাহার সমান ফনা আচমকা টেনে নেয় পেটের ভেতর।

দক্ষিনে যেও না মাঝি, কালাপানি দরিয়ায় কমোট কুমির।
তোমারে হারাই যদি গলায় কলসি বেঁধে ডুব দেবো জেনো,
তোমারে হারাই যদি ধুতুরার বিষ খেয়ে জুড়োবো পরান।
পরবাসে যাবা মাঝি, মনে ভেবো ভরা গোলা রেখে গেছ ঘরে—

সোমত্ত বয়স দেহে মাঝি-বউ-দিন গোনে, ফেরে না ভাতার,
গলায় গামছা বাঁধা হয় নাকো তার।
পেটের আগুনে পোড়ে অতপর ঘরদোর,
সোনার গতর আর সব শেষে পোড়ে তার যৌবনের কড়ি।
মাঝি-বউ দিন গোনে, তবু দিন গোনে….




৫.
গেল বছরের দেনা এ-বছর নিয়ে গেল খোরাকির ধান।
এই সনে দেনা হবে আরো, হালের বলদ গাই যাবে ব্যাঁচা,
কার্তিকের অনটনে সংসারে ডাকবে ঘোর অভাবের প্যাঁচা।
মহাজন ভালো লোক, দেনার বদলে দেবে নাড়ি ধ’রে টান-

দশানা ছ’আনা ভাগ, ধানের মাড়াই শেষে থাকে না কিছুই,
রাজভাগ মহাজন, বাদবাকি দায়-দেনা, তবু ঋন থাকে।
জীবন জড়ায়ে গেছে জীবনের এই অন্ধ অন্যায়ের পাঁকে,
যতোই টানো না কেন, এক তিল এগোবে না, টানবে পিছুই।

উপরে যে আছে তার বাড়ছে প্রশাখা-ডাল-পাতা-ফল-ফুল,
নিচের তরুটি আর বাড়ে নাকো, দিনে-দিনে খসে তার দেহ।
এমনি নিয়ম নাকি, ওরা বলে- নিয়তির এরকমই স্নেহ,
ভালোরা উপরে থাকে, অধমের চিরকাল ভেঙে যায় কূল।

এ-কথা বিশ্বাস কোরে এতকাল বেঁচে আছে মাঠের চাষারা,
তামাদি হয়েছে সুখ, নোনা ধ’রে গেছে সারা জীবনের গায়,
মজ্জায় জমেছে শীত, আন্ধার বেঁধেছে জট বুকের খাঁচায়
ভাঙতে ভাঙতে কূল ঠেকে গেছে ভিতে,শুধু বাঁচার আশারা

বেঁচে আছে, তাই নিয়ে প্রতিদিন জীবনের সাথে হয় দ্যাখা।
মৃত স্বজনের হাড় মাঝরাতে জেগে উঠে শোনায় কাহিনী,
মাংশের ভেতরে সেই কাহিনীরা জমা হয়, রক্তের ধমনী সেই কথা শোনে,
আজ শুনে রাখে- যে-কাহিনী হয় নাকো লেখা।।



৬.
কুটুম এসেছে ঘরে, সাঁচিপান সাজো বউ রুপোর বাটায়।
চিরে মুড়ি আছে কিছু? নয়তো বাতাসা দাও সাথে নারকেল।
একেবারে খালি মুখ, আর কি সেদিন আছে, আহারে আকাল!
শ্রাবনের বানের নাহান ভেসে গেছে সব-হায়রে সুদিন।

কি সুখে ছিলাম বউ! ভাত মাছ, তরকারি কিসের অভাব?
অতিত্তি বাড়িতে এসে খালি মুখে ফিরে যাবে সে কেমন কথা!
আর কি সেদিন আছে-কতো রাজা বদলায়, দিন তো ফেরে না।
কিছুই মেলে না আর, কেতাবের কলিকাল এরে বুঝি কয়?

ও বউ মাদুর দাও, ছায়ায় বসুক এসে, বাইরে যা খরা- ছেলেরা সবাই মাঠে,
পুকুরে যে জাল ফ্যালে তা-ও কেউ নেই।
দুপুর গড়ায়ে এলো- ও বউ রান্না চড়াও,
চাল দাও বেশি, আর কি সেদিন আছে!
কিছুই মেলে না আর, কিছুই মেলে না।

ঝুড়ি ভরা ফলমূল, দুই বেলা দুধ আহা কী শারান্ত গাই,
খাটাশ আটার রুটি কোনদিন ছুঁয়ে কি দেখেছি, কোনদিন?
কতো রাজা বদলায়, দিন বদলের কথা শোনায় ছেলেরা,
দিন তো ফেরে না বউ? বানের জলের মতো ভেসে যায় সব…

পশরের পাড়ে আজো এই দৃশ্য বেঁচে আছে, দৃশ্যের মানুষ।
সব গেছে, আছে শুধু আহলাদটুকু, আছে অতীতের স্মৃতি।
এইসব প্রবীনেরা হারানো দিনের গন্ধ ধ’রে রাখে আজো,
আজো তার স্বাদ পায়, আজো তার স্বাদ চায় বিলাতে অন্যকে।।


৭.
বনের হরিন নয়, বাঘ নয়, এতো রাতে চৌকিদার চলে।
হোই কে যায়? কে যায়? গঞ্জের বাতাস ফেরে হিম, নিরুত্তর।
কে যায়? কে যাবে আর! দশমির অন্ধকার একা একা যায়,
একা একা চৌকিদার আঁধারের বাঁকে বাঁকে নিজেকে তাড়ায়।
নিজেকেই প্রশ্ন করে কে যায়? কি নাম তোর ? কোথায় থাকিস?
কী তুই পাহারা দিবি, জীবনের কতোটুকু আগলাবি তুই!
ছিঁচকে-সিঁধেল চোর-আর যেই চোর থাকে দিনের আলোয়?
আর যেই চোর থাকে দেহের ভেতর, শরীরের অন্ধকারে?

রাতের আঁধারে খুঁজে তারে তুই পাবি? চৌকিদার, পাবি তারে?
যে-চোর পাহারা দেয়, পাহারার নামে করে ভয়ানক চুরি,
চুরি করে মানুষের ঘিলু-মাংস-রক্ত-হাড় বুকের বাসনা,
তারে পাবি, যে-তোর জীবন থেকে চুরি করে পূর্নিমার রাত?

যে-তোর জীবন থেকে চুরি করে পয়মন্ত দিনের খোয়াব,
যে-তোর শিশুর স্বাস্থ্য, দুধভাত, চুরি করে বোনের সিঁদুর,
তারে পাবি, যে-তোর গতর থেকে খুলে নেয় মানব-শরীর?
কিসের পাহারা তবে? কেন তবে রাত ভর রাতকে তাড়ানো?

অন্ধকার পৃথিবীতে শুধু কিছু তারা জ্বলে, দূরের নক্ষত্র। ঝিঁঝি ডাকে।
পাটের পচানি থেকে গন্ধ আনে রাতের বাতাস।
পুরোনো কবর খুঁড়ে শেয়ালেরা বের করে আধ-পচা লাশ- হোই কে যায়?
কে যায়? পৃথিবীর অন্ধকারে চৌকিদার চলে।।


৮.
' উঠোনে ছড়ালে ভাত কাকের অভাব হয়? শত কাক আসে।'
সব পাখি কাক নয়, জানা ভালো, সব কাক আসেনা তবুও,
 কিছু কিছু কাক আছে চিরকাল উড়ে চলে উজান বাতাসে-
আমিও তেমন কাক, তোমার উজান স্রোতে দাঁড়ায়ে রয়েছি।

ডাঙায় ডাঙর হয় গভীর ফাটল আর জলে বাড়ে নোনা।
এই তো আমার ঘর, রোদে জ্বলা, জলে ভেজা আমার বসতি,
এই তো আমার দেশ, এই তো আমার প্রেম,
আমার হৃদয়- তিন ভাগ জলের উপর ভাষা এক ভাগ মানবিক মাটি।

তবু সে-মাটিতে নেই আমার দখল, আমার দখলে নেই জীবনের কোন মাটি।
উজান জলের এক বিশাল ভুবনে দাঁড়ায়ে রয়েছি,
জানি দাঁড়ায়ে থাকার নাম প্রকৃত জীবন।
সকলে বসতে চায়, কেউ কেউ থাকে তবু বিরুদ্ধ স্বভাব।

বানের জলের শেষে প’ড়ে থাকে অকৃপন পলির সংসার,
আর তাই দেখে দেখে জংধরা বক্ষে-প্রানে বেজে ওঠে বাঁশি।
গাঙের জলেতে চুল খুলে দিয়ে এক বউ শরীর ভেজায়-
এই তো আমার ঘর, দিনে রাতে সে-ঘরের খ’সে পড়ে আয়ু।

গোপন ইঁদুর কাটে, কাটে এক সর্বনাশা সোনার কমোট,
আমার ঘরের ভিতে গর্ত করে অঘ্রানের কাতর সাপেরা।
এই তো আমার প্রেম,এই তো আমার ঘর,
আমার স্বদেশ- তিন ভাগ জলের উপরে ভাসা এক ভাগ মানবিক মাটি।।


৯.
শিঙেল বয়ারগুলো সারাদিন জলে ডুবে ঝাপটায় মাথা।
 দু-চারিটি ধোড়াসাপ ভয়ে ভয়ে ঘোরে ফেরে খালের কিনারে।
মাছ খায়। পাড়ে কিছু গোড়াই মল্লিক আর খয়েরি শালিক-
 ভাবো তো এমন দৃশ্য কবে তুমি দেখেছিলে, কতোকাল আগে?

গোরুর বাথালে এক শ্যামলা রাখাল তার কী সুরেলা বাঁশি মনে পড়ে
রোদের পাহারা-ঘেরা দূর এক বিরান প্রান্তরে সেই বাঁকা ঝাউগাছ,
রাজা-প্রজাপতি আর ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে?
মহুয়ার পালা শুনে কী যে কষ্ট বুকে নিয়ে ফেরা- মনে পড়ে?

জীবনের খোলা রাতে আজো ফুরোয় না সেই মহুয়ার পালা,
হোমরা বাইদ্যার রোষ ফেরে আজো মহুয়ার পেছন পেছন,

বিষের খঞ্জর বেঁধে স্বপ্নবান জীবনের চাঁদ সদাগর-
বুকের খোয়াব নিয়ে জীবনের ঘোরতম আঁধারে পালাই

খঞ্জর ছাড়ে না তবু। কী দিয়ে ফেরাবো এই বিষের খঞ্জর?
নাচের মুদ্রার মধ্যে ঝলোমলো কোরে ওঠে মৃত্যুর সমন,
ঢোলের শব্দের মধ্যে বেজে ওঠে ঘাতকের অনিবার্য রোষ।
বিষের খঞ্জর আমি কী দিয়ে ফেরাবো বলো, কী দিয়ে ফেরাবো?

মরা নদীটির পাড়ে এক শংখচিল কাঁদে। দুপুর গড়ায়।
 কে যেন আকাশে ভাঙে একরাশ শাদা-কালো মেঘের শিমুল। রাত নামে।
অন্ধকার ঘিরে আসে বাইদ্যার দলের নাহান বিষের খঞ্জর হাতে-
এ জীবনে ফুরায় না মহুয়ার পালা।।


১০.
তালাক হয়েছে তার আশ্বিনের শেষ দিন অপর বেলায়।
অকারনে। লোকে বলে-সোয়ামির দিকে তার ছিলো না নজর,
পাড়া বেড়ানিয়া মাগি যার তার ঘরে গেছে সন্ধা কি ফজর-
অপরাধ বড়ো তার, পাথর ভেঙেছে সে-যে মাটির ঢেলায়।

সোমত্ত জোয়ার ঘাড় ফেরায়ে বলেছে মেয়ে-যাবো না,যাবো না।
ভরা অভাবের মাসে এখন কোথায় যাবো, কে দেবে খোরাকি?
যে অঙ্গ সোহাগ চায় সেইখানে লাথি নিয়ে নেমেছে একাকী। অন্ধকারে।
নামতে হয়েছে তাকে, তার কথা হয় নাই শোনা।

সোয়ামির ঘর থেকে তালাক হয়েছে তার, জোটেনি তালাক জীবনের কাছ থেকে।
জীবন নিয়েছে তারে অন্ধকারে টেনে।
মজা পুকুরের পাড়ে ভিন পুরুষেরা তার দেহখানা ছেনে চিনিয়ে দিয়েছে দেহ,
জীবনের কানাগলি, অন্ধকার বাঁক।

বুকের আগুন আজ জ্বেলেছে সে তার দেহে, দেহের খাঁচায়।
বধু নয়, মাতা নয়, সে এখন শুধু এক সর্বনাশা মেয়ে-
সংসারের কূল ভাঙে উথাল গাঙের কালো অন্ধজল হয়ে,
 মেঘের মতোন সে-যে রোদে পোড়া কিষানের আশাকে নাচায়।

ঘোলাটে জোস্নার রাতে দড়ি হাতে যায়নি সে গাবগাছ-তলা,
এনড্রিন ভালবেসে পরান জুড়োতে তার হয় নাই সাধ।
বেঁচে থেকে জীবনের পচা-গলা অন্ধকারে নিয়েছে সে স্বাদ জীবনের-
জীবন দেখুক এক মানুষের অন্ধকারে জ্বলা।।


১১.
ভেজানো গাবের গন্ধে নিকেরি পাড়ায় নামে পূর্নিমার রাত।
জোয়ার ফেনায় ওঠে-গাঙপাড় ছেড়ে যায় জেলে-নাওগুলো।
জোয়ার ফেনায় উঠে- ঝ’রে পড়ে জোস্নাহীন পূর্নিমার ধুলো।
মাছের মতোন জালে আটকা পড়েছে আজ জেলের বরাত।

আজ কোন জোস্না নেই, আজ কোন স্বপ্ন নেই মানব পাড়ায়।
যে-মাছেরা ঢাকা পড়ে বরফে ও নুনে,
যে-মাছেরা গাঙপাড়ে খরায় শুকায় আর শীতে ধলা পোকা জন্মে
যে-মাছের হাড়ে- সেই সব মাছের জীবনে আজ বুক-ভাঙা মানুষ জাড়ায়।

জন্মেই জড়ায়ে গেছি মানুষের সুচতুর জালে ও খাঁচায়,
তারপর যতোবার জোয়ার এসেছে গাঙে,
এসেছে প্লাবন কূল ভেঙে গেছে শুধু,
ভাঙে নাই খাঁচা জাল, জালের বাঁধান।
চিরকাল স্বপ্ন তবু জেলের নৌকার মতো জীবন ভাসায়-

জেলের কুমারী কন্যা এখনো খোঁপায় গোঁজে কলাবতী ফুল,
দরিয়ার মতো কালো এক বুকে পিষ্ট হতে ইচ্ছা তার কাঁদে,
ভাঙা গাঙপাড়ে তবু কালো মেয়ে স্বপ্ন খোঁজে জোস্নাহীন চাঁদে।
শুটকির গন্ধ আসে, জোয়ারের জলে ভাসে পরানের কূল।

ওঠে দুর্দিনের ঘোর উৎসবে মুখর হয়ে দরিয়ার পাড়।
তুফান জলের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে নাও,
ছোটে যে-জীবন স্বপ্ন দিয়ে মানুষেরা কি রকম শক্ত তারে করেছে সীবন-
 উঠোনে শুকোয় জাল, শুকোয় না নিকেরির কষ্টে-ভেজা হাড়।।


১২.
ভরা বসন্তের দিনে এ-মধুর চাক তুমি ভেঙো না মৌয়াল,
মধুপোকা আসবে না, ভাঙা চাকে আসবে না রাঙা মউমাছি।
দারুন যক্ষের ধন আমি শুধু এইটুকু স্বপ্ন নিয়ে আছি।
ভেঙো না মধুর চাক, বিষ-পিপড়েয় ছেয়ে যাবে ডাল-

রাতের শিয়াল আসে, ঝাঁ বেঁধে বানরেরা আসে অসময়,
অন্ধকার বাদাবনে পাতার আড়ালে রাখি লুকায়ে শরীর,
শরীর লুকোনো যায়, কী কোরে লোকোবো আমি সৌরভের তীর!
কী কোরে লুকোবো এই বসন্ত বাহার আমি তৃপ্ত তৃষ্ণাময়!

এমন চাঁদের রাতে চাকে হাত দিও নাকো রঙিলা নাগর,
তিষ্ণার গাঙেতে জল উথালি পাথালি করে সয় না পরানে।
অতো কি বোঝাও তুমি পূর্নিমার চাঁদ আর বসন্তের মানে? বুঝি সব।
জোয়ার এসেছে গাঙে খুলে যায় বুকের দুয়োর।

তুমি যদি কথা দাও আমারি কপালে দেবে সিন্দুরের টিপ,
বুক ভরা স্বপ্ন দেবে, আর দেবে জীবনের আধেক সীমানা,
দিঘির জলের মতো কালো এক শিশু দেবে তবে নেই মানা,
তুমি হয়ো ঘর আর আমি হবো অন্ধকারে ঘরের প্রদীপ।

যদি তুমি কথা দাও কার্তিকের অনটনে দেবে না তালাক,
তোমার বুকের নিচে আমি তবে ভূমি হবো, হবো এক নদী,
 হৃদয়ের জল দিয়ে ভেজাবো তোমার কূল আমি নিরবধি-
তোমার জবান যদি সত্য হয় তবে তার বাসনা জ্বালাক।।


১৩.
কলার ভেলায় লাশ, সাথে ভেসে চলে এক স্বপ্নবান বধু।
হাঙর কুমির আসে, আছে ঝড়, অন্ধকার দরিয়ার বান,
লাশের শরীর থেকে মাংশ খসে, বেহুলার অসীম পরান,
কিছুতে টলে না স্বপ্ন, আকাংখার শক্ত হাত মেলে রাখে বঁধু …

ওলো ও বেদেনি শোন, ছোবল দিয়েছে বুকে জাত কালসাপ,
নীলবর্ন হয়ে আসে সোনার গতরখানা অঙ্গ জ্বলে বিষে,
কী সাপে দংশিলো লখা? ঘোরবর্ন সাপ ছিলো অন্ধকারে মিশে।
উদোম নাচন দিয়ে দুই কানে শোনা তুই মন্ত্রের আলাপ।

কী সাপে দংশিলো লখা! জীবন আন্ধার হলো, অঙ্গ হলো কালি,
এ-কোন সাপের বিষ জীবন নেয় না শুধু শরীর জ্বালায়,
পরান পোড়ায় নামে বিষের নহর যেন রক্তের নালায়- দোহাই বেদেনি তোর,
বিষের বাগানে তুই বিষহরা মালি

মন্ত্র দে,মন্ত্র দে তুই, ছোবলের ক্ষতে রাখ বিষমাখা ঠোঁট ।
বিষে নীল লখিন্দর ভাসে দ্যাখ পৃথিবীর কীর্তনখোলায়,
জলের উপরে ভাসে বিষাহত আকাংখারা, জলের ঘোলায়- কী সাপে দংশিলো লখা,
জীবনের নাড়ি কাটে বিষের কমোট?

ওড়ে আকাশে শকুন। উত্তর দিগন্ত ঘিরে কালো মেঘ আসে।
কেউ কি বেহুলা নেই স্বপ্নবান কোন এক তরুন বেদেনি?
স্বজন-রক্তের কাছে, স্বজন-হাড়ের কাছে দায়বদ্ধ, ঋনী?
কেউ কি বেহুলা নেই হাড়ের খোয়াব নিয়ে বৈরী জলে ভাসে??


১৪.
এমন ঝড়ের রাতে আচমকা ভেঙে দিলে নায়ের গলুই!
আমারে ভাসালে তুমি মাঝগাঙে, দরিয়ার সর্বনাশা জলে,
আমারে পোড়ালে রোদে দুর্যোগের অনাবৃত আকাশের তলে।
শিরদাঁড়া ভেঙে আসে, এ পাষান ভার আজ কোনখানে থুই?

এই দগ্ধ মসলিন, এ-ছেঁড়া কাপড় ফের কোন তাঁতে বুনি?
মৌশুমি পাখির ঝাঁক ধীরে ধীরে জমা হয় হেমন্তের মাঠে, পচে রস।
জিরান রসের তাড়ি অঘ্রানের অবসাদ কাটে-
আমি শুধু অন্ধকারে একা একা দুর্দিনের পদশব্দ শুনি।

এতো যে কষ্টের ধান! মাঠভরা ধানে তুমি নামালে বয়ার,
আগুনে পোড়ালে ক্ষেত, পাকা শষ্য,ঘরে দিলে করাল আগুন।
আমার শরীর আর মাথার মগজ জ্বলে, জ্ব’লে উঠে খুন,
আমিও ছিঁড়তে পারি এই রুক্ষ বুনো হাতে বেয়ারা আঁধার।

মালশায় পোড়ে তুষ। নবজাতকের কান্না ভেসে আসে দোরে,
বিরান সংসারে জাগে নোতুন মানুষ এক নোতুন খোয়াব,
তুমুল চিৎকারে ভাঙে জংধরা হৃদয়ের নিরীহ স্বভাব।
বুকের ভেতর এক তাজা শিশু জন্ম নেয় প্রানবন্ত ভোরে।

আমিও ফিরতে পারি, বানের মতোন পারি ভাসাতে দুকূল,
কেউটে সাপের মতো রুখে পারি ফনা তুলে আমিও দাঁড়াতে,
পারি ভূমিকম্পের মতোন কালো পৃথিবীকে দুহাতে নাড়াতে-
আমিও আনতে পারি সবলে ছিনিয়ে ওই স্বপ্নময় ফুল।।


১৫.
এতোকাল ধ’রে শুধু আকাশ মেঘলা হয় নামে না বাদল,
নাড়ি-ছেঁড়া ব্যথা ওঠে, কাতরায় খালি ঘরে চুড়ান্ত পোয়াতি।
পশ্চিমের মেঘ দেখে হাটবারে দোকানিরা গুটায় বেসাতি,
বরষা আসে না-শুধু মেঘ জ’মে ওঠে, বাজে মেঘের মাদল।

সময় গড়ায় আর ভাঙা ঘরে চলে রোজ মৃত্যুর মহড়া।
আমাদের স্বপ্নগুলো ক্রমশ ঝিমায়ে পড়ে বয়সের ভারে,
ভরা পূর্নিমায় কেউ আঙুল রাখেনা আর দোতারার তারে,
ঘানির জোয়াল টানে একদার স্বপ্নবান প্রানবন্ত ঘোড়া।

বাওয়ালীর দুঃখ বোঝে বাদাবনে জোংড়াখুটা, জেলে ও মৌয়াল,
জনপদে তারা আর চেনে না নিজের মুখ।
আলাদা মানুষ তারা সব বিষের আগুনে পোড়া বিষমগ্ন মালশার তুষ,
পোড়ায় অন্যের ঘর, আর পোড়ে নিজে নিজে দগ্ধ চিরকাল।

আমরা দেখিনি আর পরষ্পর হাত খুলে গাঢ় কোনো সাঁঝে,
প্রতিটি হাতের তালু এক চিহ্ন ধ;রে আছে দেখি নাই কেউ।
পরষ্পর চেয়ে থেকে দেখি নাই সবার বুকেই এক ঢেউ,
সবার একই মুখ, সবার একই ভাষা চামড়ার ভাঁজে।

বড়শির সুতো ধরে অন্ধকারে বোসে থাকে রুগ্ন এক জেলে,
মাছের খোয়াব তার চোখের পিঁচুটি হয়ে ঢেকে রাখে চোখ।
বুকে তার ক্ষুধায় খরায় পোড়া দূরবর্তী স্বজনের শোক-
এক জেলে চায় যেন নিখিল ধোয়াতে তার নম্র স্বপ্ন ঢেলে।।


১৬.
কোন কি প্রার্থনা নেই? কিছুই কি চাওয়ার নেই বিশ্বাসের কাছে?
সংসার বিরাগি যেন একতারা হাতে এক বেভুল বাউল,
কি সাধে নিয়েছো তুলে মাটি থেকে মানবিক আকাংখার মূল?
আছে, আছে, তোমারো রক্তের স্রোতে বাসনার ব্রেনোজল আছে।

তোমার অরন্যে আছে অপরুপ স্বপ্ন-আঁকা চিতল হরিন।
তন্দ্রাতুর হরিয়াল ডাকা ফাল্গুনের রাত। শাদা খরগোশ।
তোমার কিনারে আছে পাললিক নোনাজল, জলের পরশ,
সরল শিশিরে ধোয়া সোনালিম শস্যময় হেমন্তের দিন।

তোমার পরানে আছে বাঘের থাবায় এক আহত হরিন-
বাঘে-ধরা পাঁজরের ক্ষতে তার মাংশ পচে, জন্মে নীল পোকা,
শীতল ব্যাথায় বাঁধা হরিনটি বোঝে নাই অরন্যের ধোকা,
এখন আপন মাংশে পচনের বৈরী বিষ ওঠায় সঙ্গিন।

কিছু কি প্রার্থনা নেই? তোমার আঁধার দ্যাখো তোমাকে ভাষায়।
তাবৎ আলোর মধ্যে এক কনা অমা থাকে পচনের বিষ,
দিনে দিনে বাড়ে ক্ষত, পোকা জন্মে, জন্মে কালো আঁধার-পুরীষ।
 তোমার আঁধার রাখে তোমাকে জড়ায়ে ওই তোমার খাঁচায়।

তোমার জীবন শুধু তোমাকে তাড়ায় বন্দি তোমার জীবনে।
নাওখানা বাঁধা থাকে খেয়াঘাটে মাঝিহীন অপর বেলায়,
দুটি পাড় শূন্য চোখে ভাসে যেন কূল-ভাঙা গাঙের ভেলায়-
আহত হরিন এক পচা মাংশে নীল পোকা তোমার পরানে।।

১৭.
আমার লাটাই সুতা হাতে র’লো ঘুড্ডিখানা হারালো কোথায়?
লিলুয়া বাতাস পেয়ে জীবনের স্বপ্ন-ঘুড়ি উড়ায়ে ছিলাম,
হায়রে আকাশ তার অঙনে ডাকলো আজ নীলের নিলাম,
কারা যেন ঢেকে দিলো রোদের সজারুটারে মেঘের কাঁথায়।

সব কথা ফুরোলো না, চোখ ভ’রে সব দ্যাখা হলো নাকো দ্যাখা,
আশ্বিনের মেঘের মতোন ঝ’রে গেল চোখের পলকে সব আকাংখার জল,
গেল শিশিরের মতো ঝ’রে গহিন খোয়াব।
সব কথা ফুরোলো না, হৃদয়ের সব তৃষ্ণা হলো নাকো লেখা।

দিনের আহার শেষে ধবল পাখিটি আর ফিরলো না নীড়ে।
সব বাঁশি বাজলো না, পেলো না হাতের ছোঁয়া সবকটি তার,
ফসল বোনার আগে ভেঙে প’ড়ে গেল জলে গাঙের কিনার।
বুকের শিখাটি জ্ব’লে উঠলো না বেদনার অন্ধকার ছিঁড়ে-

গাঁয়ের হালোট বেয়ে গরুগুলো ঘোরে ফেরে।হাটবারে আসে।
জাংলা থেকে শিম পাড়ে ঘরের নোতুন বউ, মন উচাটন।
খেয়াঘাটে লোক জমে। ওপাড়ায় চুরি হয়। থামে না জীবন-
গাঙের উজান স্রোত চিরকাল যেন এক কালো নৌকো ভাসে।

সব কথা ফুরোলো না এই কথা ফুরোবে না,
তবু একদিন দিনের আহার শেষে ধবল পাখিটি আর ফিরবে না নীড়ে,
দুই ফোঁটা নোনাজল মিশে যাবে জীবনের অগনন ভীড়ে।
জোয়ার ভাটায় নদী অবিচল শুধে যাবে পৃথিবীর ঋন।।


১৮.
ঘন্টায় তিরিশ টাকা। কম নাই। আমাদেরও প্যাট আছে সাব,
আমাদেরও সাধ আছে।পাঁচ টাকা সের চাল, কেমনে বাঁচুম!
গতরে তুফান তুলে দুয়ারে লাগালো খিল পাড়ার রমনী,
তখন ঝিমায় গেছে নবমীর ঘোলাচাঁদ দূরের আকাশে…

নর্দমায় পচা কফ, কালো রক্ত, বীর্য,মুত, মাতালের বমি।
বাতাশে মদের গন্ধ, বেসুরো গজল আর খিলখিল হাসি।
ঘুমন্ত শিশুর পাশে পিষ্ট হয় ন্যাংটা দেহ, ভাড়াটে শরীর,
ষ্টোভে ভাত ফোটে, দরোজায় গেঁথে থাকে দালালের ধূর্ত চোখ।

জ্বলে সুখ, গেরস্থালি-শীতল আগুনে তার মজ্জা-মাংশ জ্বলে,
বয়স্ক জরায়ু যেন ক্রমশ শুকায়ে আসে জীবনের স্বাদ।
নালায় থুবড়ে পড়ে সাধের বাসনগুলো মাতালের মতো,
বেসুরে হার্মোনিয়াম বাজে তার রংচটা বর্নহীন বুকে-

ফ্যাকাশে সকাল ভাঙা দেয়ালের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়,
নিশিথের ক্ষতটারে মোছাতে পারে না।
পারে না রোদের জল ধোয়াতে জীবন,
এই নষ্ট ফল, এই মানুষের নষ্ট হিয়া- সূর্য শুধু স্বপ্ন আনে,
মানুষের ভাঙা-স্বপ্ন জোড়াতে পারেনা।

নেশায় ঘোলাটে চোখ, টলতে টলতে যায় বুকের বাসনা,
অন্ধকারে শাড়ি খোলে কারো বোন, কারো বধু, কারো বা জননী।
দেহের আগুন নয়, ক্ষুধার আগুনে পোড়ে এই সব বুক,
জীবনের মাংশে এক বিষফোড়া, জীবনের গভীর অসুখ।।

১৯.
মলিন আজান শুনে জেগে ওঠে পোলাটার ভাতারখাগি মা,
শরীর সয় না আর, ভরা অভাবের মাস এখন কার্তিক।
সবার হাড়িতে টান। সাত গ্রাম ঘুরে তবু মেলে নাকো ভিখ-
ক্ষীনকন্ঠ মুয়াজ্জিন, দুবেলা জোটে না তারো।অভাবের সীমা

গাঙের ভাঙন হয়ে বেড়ে চলে জমিহারা কৃষকের মতো।
গঞ্জে বাতাসে ওড়ে শাদা কালো মনোরম ভিনদেশী নোট,
সহ্যের বলদ দুটি খোঁড়ায় সে-ভারে ন্যুব্জ, সয় না সে-চোট।
জীবনের হাড়ে মাংশে বাড়ে এক কালো রোগ, কালো এক ক্ষত।

কেন এ-বিহান আসে? খুপড়ির অন্ধকারে কেন আসে ভোর?
ঘুম তো মরন, সেই মরনের মধ্যে থাকি, টাটায় না খিদে,
অন্ধকার, সেই ভালো, অন্ধকারে বেঁচে-থাকা সেই তো সুবিধে।
সকলি আন্ধার যার একটু সলোকে কিবা কাটে তার ঘোর!

থাকুক আন্ধার রাত তামাম দুনিয়া ঘিরে, না হোক সকাল।
উদোম গতরখানা কী বস্ত্রে লুকোই দিনে, কিসের আড়ালে?
কী দিয়ে জুড়োই জ্বালা, নিভাই জঠর? জীবনের শূন্য ডালে কী কোরে ফুটাই পাতা?
চারিদিক ঘিরে আসে সর্বনাশা কাল।

মুয়াজ্জিন কাকে ডাকে? কার হয়ে সাক্ষী দেয় না-বোঝা ভাষায়?
কিছুই বোঝে না সে যে, ম্লান কন্ঠে ডাকে শুধু আল্লাহ মহান,
পাঁজরের হাড়ে তার শব্দহীন বেজে ওঠে ক্ষুধার আজান- রাত্রি শেষ।
পাখি ডাকে। আরেক আঁধার তবু পৃথিবী ভাসায়।


২০.
আঁখবনে ছায়া নড়ে।মধ্যরাত দুলে ওঠে শীতের বাতাসে।
ছায়া নড়ে- এতোরাতে কার ছায়া? কুয়াশায় কাঁপে কার পাপ?
দূরে, আকাশের পশ্চিম কিনার ঘেঁষে ক্ষ’য়ে যাওয়া ঠান্ডা চাঁদ,
খুবলে উঠায়ে নেয় যেন এক গলা-চোখ, ভিজে, রক্তমাখা।

কার ছায়া নড়ে ওই আধো আলো অন্ধকারে, কুয়াশার ফাঁকে!
হাড্ডিসার রোগা ভাঙা গতকালও দুইঘর ছেড়ে গেছে গ্রাম,
তেঁতুলের মগডালে গলা বেঁধে ঝুলে আছে খাদেমের বাপ-
গেরাম উজাড় প্রায়, বানে ও ক্ষুধার ঘায়ে মরে নাই যারা

রঙিলা শহর শেষে গিলেছে তাদের। তাদের লাশের নামে,
তাদের হাড়ের নামে, তাদের রক্তের নামে আজ রাজনীতি জ’মে ওঠে জনসভা,
হাততালি, নগরের বিশাল মিছিল… আঁখবনে কার ছায়া?
মাঝরাতে অন্ধকারে জোড়া ছায়া নড়ে।

নষ্ট চোখের নাহান রক্তমাখা ভেজা চাঁদ নেমে যায় দূরে-
ফরাক রাখেনা ক্ষুধা, একপাতে এনে দেয় কুকুর শিয়াল।
হাভাত ক্ষুধায় ক্লান্ত বেঘোরে ঘুমায় বুড়ো ছিদাম নিকেরি,
গোলায় মজুদ ধান, মহাজন নিদ্রাহীন, বাড়িতে পাহারা।

দুঃস্বপ্নে জেগে ওঠে ছিদামের চোখ, তার চোখে ছায়া নড়ে,
এক নয়, জোড়া নয়, শত শত ছায়া নড়ে-
তারা শুধু ছায়া ধানের গোলার পাশে জমা হয় শত ছায়া-
তারা শুধু ছায়া তারা এক ছিদামের বুকের ভেতরে জমা আক্রোশের ছায়া।।


২১.
বড়ো চেনা এই চোখ, ঘন ভুরু, এই রঙ শ্যামলা শরীর,
এই ঠোঁট বড়ো চেনা উজান গাঙের মতো কোমরের বাঁক,
এ-পুষ্ট ভরাট মাই পুষে রাখে যেন নোনা দরিয়ার ডাক,
বড়ো চেনা এই হাত, নিশিথের আলিঙ্গনে কামনা-অধীর।

বড়ো চেনা এই ঘ্রান, বৃষ্টি ভেজা মাটি এই দেহের তুলনা।
তামাটে তরুন চাষা লাঙলে চিরেছে এই নওলা জমিন,
কিশোর সবুজ ধান ধ’রে আছে তার সেই শরমের চিন-
এখন সে মৃত, ন্যাংটা, পচা লাশ-তার কথা এখন তুলো না।

এ-ও খুব চেনা কথা, এই কথা শুনেছিলো কুসুমের হাড়।
থই থই ভরা বুক সোমত্ত শরীরে বুনো শ্যাওড়ার ঘ্রান,
বৈশাখে নিখোজ মেয়ে আষাঢ়ে উঠলো খেয়ে লাঙলের টান।
‘চুপ চুপ’- এই কথা শুনেছিলো মাটি আর মেঘলা পাহাড়।

বড়ো চেনা ওই স্বর, ওই কন্ঠ ‘চুপ চুপ’ বনেদি শাসন-
ওইখানে পোড়ে প্রেম, হাড় মাংশ, ওইখানে হাবিয়া দোজখ,
জীবন-গাছের গোড়া ওই হাত কাটে,
ওই সর্বনাশা চোখ যেদিকে ফেরায় পোড়ে ঘরদোর,
ভিটেমাটি, ভাতের বাসন।

এই যুদ্ধ বড়ো চেনা, চোখের আড়ালে বাঘ,
গোপন লড়াই, কখন নিয়েছে পিছু,
মরনে জড়ায়ে গেছি পাই নাই টের।
জীবনের রক্ত মাংশ, প্রিয় মুখ হারায়েছি ঢের আমাদের-
মরন জীবনে থাকে, জান বাজি, আমি ওই বাঘটাকে চাই।।





Post a Comment

0 Comments