রবি সমগ্র



০১। বর্ষার দিনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এমন দিনে তারে বলা যায়।
এমন ঘনঘাের বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।।
দুজনে মুখােমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব ।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।
বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,
চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ ।
সে কথা আঁখিনীরে মিশিয়া যাবে ধীরে,
বাদলৰায়ে তার অবসান
সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ ।।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনােভার!
শ্রাবণ বরিষণে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার।
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।

আছে তাে তার পরে বারাে মাস
উঠিবে কত কথা, কত হাস।
আসিবে কত লােক, কত-না দুখশােক,।
সে কথা কোনখানে পাবে নাশ—
জগৎ চলে যাবে বারাে মাস।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
এমন ঘনঘাের বরিষায়।


.০২। এক গায়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি।

সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি

তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া

চড়ে বেড়ায় মােদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া

কোলের পরে নিই তাহারে তুলে ।।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তাে জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
দুইটি পাড়ায় বড়ােই কাছাকাছি,

মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাক
তাদের বনের অনেক মধুমাছি।

মােদের বনে বাঁধে মধুর চাক !
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা

ভেসে আসে মােদের বাঁধা ঘাটে,
তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা।

বেচতে আসে মােদের পাড়ার হাটে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তাে জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে।
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

আমাদের এই গ্রামের গলি-'পরে
আমের বােলে ভরে আমের বন,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে

| মােদের খেতে তখন ফোটে শণ ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা।

আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছােটে।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা,

আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তাে জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।।


০৩। মনে পড়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে।

হঠাৎ অকারণে।
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে।

কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন

আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার

দোলনা ঠেলে ঠেলে ;
মা গিয়েছে, যেতে যেতে

গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।

শুধু যখন আশ্বিনেতে

ভােরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে

ফুলের গন্ধ আসে,
তখন কেন মায়ের কথা।

আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই

ফুলের সাজি বয়ে,
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই

মায়ের গন্ধ হয়ে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে।

শুধু যখন বসি গিয়ে

শােবার ঘরের কোণে;
জানলা থেকে তাকাই দূরে।

নীল আকাশের দিকে,
মনে হয় মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে ।
কোলের পরে ধরে কবে

দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে।

সারা আকাশ ছেয়ে।



০৪। কৃপণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম

গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তােমার স্বর্ণাথে ।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম

লাগতেছিল চক্ষে মম
কী বিচিত্র শােভা তােমার,

কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম,

এ কোন্ মহারাজ।
আজি শুভক্ষণে রাত পােহালাে।

ভেবেছিলেম তবে,
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে।

ফিরতে নাহি হবে।
বাহির হতে নাহি হতে
কাহার দেখা পেলেম পথে,
চলিতে রথ ধনধান্য
ছড়াবে দুই ধারে
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব,

নেব ভারে ভারে ।।
দেখি সহসা রথ থেমে গেল।

আমার কাছে এসে,
আমার মুখপানে চেয়ে।
নামলে তুমি হেসে।
দেখে মুখের প্রসন্নতা
জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা,

হেনকালে কিসের লাগি

তুমি অকস্মাৎ
‘আমায় কিছু দাও গো' বলে।

বাড়িয়ে দিলে হাত।
মরি, এ কী কথা রাজাধিরাজ,

‘আমায় দাও গাে কিছু' !
শুনে ক্ষণকালের তরে

| রইনু মাথা-নিচু।
তােমার কী-বা অভাব আছে।
ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে।
এ কেবল কৌতুকের বশে

আমায় প্রবঞ্চনা।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে

একটি ছােটো কণা।
যবে পাত্রখানি ঘরে এনে

উজাড় করি এ কী!
ভিক্ষামাঝে একটি ছােটো

সোনার কণা দেখি ।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
সূর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে

দুটি নয়ন ভরে
তােমায় কেন দিই নি আমার

সকল শূন্য করে ।।




০৫। প্রভাত-উৎসব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৃদয় আজি মাের কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ।
প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি,
আকাশ-পানে চাই কী জানি কারে দেখি ॥
পুরবমেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা,
অরুণরথচূড়া আধেক যায় দেখা ।
তরুণ আলাে দেখে পাখির কলরব,
মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব ॥
আকাশ, এসাে এসাে ডাকিছ বুঝি ভাই-
গেছি তাে তােরি বুকে, আমি তাে হেথা নাই।।
প্রভাত-আলাে-সাথে ছড়ায় প্রাণ মাের,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তাের ॥
ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও, ।
অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও।
আকাশপারাবার বুঝি হে পার হবে-
আমারে লও তবে, আমারে লও তবে ॥



০৬। বিদায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও ?

তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন ।

ওগাে বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মােরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুত রথে দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তােমা হতে বহু দূরে মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখরচূড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরানাে নাম ।
ফিরিবার পথ নাহি ; দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায় ।
কোনােদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে

বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে-রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,

ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখাে, কিছু মাের পিছে রহিল সে

তােমার প্রাণের প্রান্তে ; বিস্মৃতপ্রদোষে

হয় তাে দিবে সে জ্যোতি,
হয়তাে ধরিবে কভু নামহারা আপুর মুরতি।

তবু সে তাে স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মাের, সেই মৃত্যুঞ্জয়-
সে আমার প্রেম তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অঘ্য তোমার উদ্দেশে।

পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে

কালের যাত্রায় ।
হে বন্ধু, বিদায়।
তােমার হয় নি কোন ক্ষতি।।
মর্তের মৃত্তিকা মাের,

তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি

যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হােক তব সন্ধ্যাবেলা-পূজার সে খেলা |
ব্যাঘাত পাবে না মাের প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে ;

তৃষার্ত আবেগ বেগে।
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনাে ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তােমার মানসভােজে সযত্নে সাজালে।
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়।

তার সাথে দিব না মিশায়ে।
যা মাের ধূলির ধন, যা মাের চক্ষের জলে ভিজে।

আজো তুমি নিজে

হয়তাে-বা করিবে রচন
মাের স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তােমার বচন।

ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায় ।।
হে বন্ধু, বিদায় ।।
মাের লাগি করিয়াে না শােক-
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলােক।

মাের পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে

সে-ই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি রজনীগন্ধার বৃন্তখানি।
যে পারে সাজাতে অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,


যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়।

ভালােমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।

তােমারে যা দিয়েছিনু, তার ।
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।

হেথা মাের তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডুষ ভরিয়া করে পান।

হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম ।
ওগাে তুমি নিরুপম,

হে ঐশ্বর্যবান,
তােমারে যা দিয়েছিনু সে তােমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।।

হে বন্ধু, বিদায়।



০৭। পরিচয়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে,

বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে।
তােমরা শুধায়েছিলে মােরে ডাকি
পরিচয় কোনাে আছে নাকি, যাবে কোনখানে ।
আমি শুধু বলেছি, কে জানে ।
নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান,
একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান ।

সেই গান শুনি
কুসুমিত তরুতলে তরুণতরুণী

তুলিল অশােক,
মাের হাতে দিয়ে তারা কহিল, এ আমাদেরই লােক।'

আর কিছু নয়,
সে মাের প্রথম পরিচয় ।।
তার পরে জোয়ারের বেলা
সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা ;

কোকিলের ক্লান্ত গানে।
বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে ;
কনকচঁাপার দল পড়ে ঝুরে,

ভেসে যায় দূরে
ফারুনের উৎসবরাতির।

নিমন্ত্রণলিখন-পাতির
ছিন্ন অংশ তারা-অর্থহারা।

ভাটার গভীর টানে
তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে।
নূতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে

শুধাইছে দূর হতে চেয়ে
‘সন্ধ্যার তারার দিকে

বহিয়া চলেছে তরণী কে ।
সেতারেতে বাঁধিলাম তার,

গাহিলাম আরবার
মাের নাম এই বলে খ্যাত হােক,
আমি তােমাদেরই লােক-আর কিছু নয়,

এই হােক শেষ পরিচয়।।



০৮। দেবতার গ্রাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে-
মৈত্রমহাশয় যাবে সাগরসংগমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী, নৌকাটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে ।
পূণ্যলাভাতুর
মােক্ষদা কহিল আসি, ‘হে দাদা ঠাকুর,
আমি তব হব সাথি ।' বিধবা যুবতি,
দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে-অনুরােধ তার।
এড়ানাে কঠিন বড়াে। স্থান কোথা আর
মৈত্র কহিলেন তারে। পায়ে ধরি তব'।
বিধবা কহিল কাদি, স্থান করি লব
কোনােমতে এক ধারে।' ভিজে গেল মন;
তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালাে ব্রাহ্মণ,
নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?
উত্তর করিলাে নারী, 'রাখাল ? সে রবে
আপন মাসির কাছে। তার জন্ম-‘পরে
বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন।
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
মানুষ করেছে যত্নে-সেই হতে ছেলে।
মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে ।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন।
কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মার চেয়ে আপনার মাসিমার বুকে।

সমত হইল বি । মােক্ষদা সতুর
প্রস্তুত হইল বাধি জিনিস-পত্তর,
প্রণমিয়া গুরুজনে,সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শােক-অশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে, সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী-'পরে উঠি
নিশ্চিন্ত নীরবে। তুই হেথা কেন ওরে
মা শুধালাে; সে কহিল, 'যাইব সাগরে ।
যাইবি সাগরে! আরে,ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়।' পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
সে কহিল দুটি কথা, 'যাইব সাগরে।
যত তার বাহু ধরে টানাটানি করে।
রহিল সে তরণী আঁকড়ি । অবশেষে
ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
“থাক থাক্‌, সঙ্গে যাক। 'মা রাগিয়া বলে,
‘চল তােরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!'
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে।
অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে।
বিধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
নারায়ণ নারায়ণ’ করিল স্মরণ ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে
করণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
“ছি ছি ছি,এমন কথা বলিবার নয় ।
রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা-
অন্নদা লােকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, 'বাছা, কোথা যাবি ওরে!'
রাখাল কহিল হাসি, ‘চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি' । পাগলের প্রায়
অনুদা কহিল ডাকি, ঠাকুরমশায়,
বড়াে যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,

কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার।
মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও।
কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।
রাখাল কহিল, “মাসি, যাইব সাগরে,
আবার ফিরিব আমি। বিপ্র স্নেহভরে
কহিলেন, “যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তােমার রাখাল লাগি কোনাে ভয় নাই ।।
এখন শীতের দিন, শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা,পথের বিপদ
কিছু নাই-যাতায়াতে মাস-দুই কাল-
তােমারে ফিরায়ে দিব তােমার রাখাল।'
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি।
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে । হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।
যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা,
তরণী তীরেতে বাধা অপরাহ্নবেলা
জোয়ারের আশে । কৌতুহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ।
মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লােলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রুর
খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা।
ফুসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা।
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী,অয়ি মৌনমূক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন, ।
সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন

শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুঙ্গে, কী বিপুল টানে
দিগন্ত বিস্তৃত তব শান্ত বহু পানে!
চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে,
ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?
সহসা স্তিমিত জলে আবেগ সঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ,মৃদু আর্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে-
আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি।
ত্বরিতে উত্তরমুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে,
‘দেশে পঁহুছিতে আর কতদিন আছে?'
সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর বায়ুর বেগ ক্রমে উঠে বেড়ে ।
রূপনারাণের মুখে পড়ি বালুচর
সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর।
জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরসমীরে।
উত্তাল উদ্দাম । তরণী ভিড়াও তীরে
উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল ।
কোথা তীর! চারি দিকে ক্ষিপ্তোনুও জল
আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে এক দিকে যায় দেখা
অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা-
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি।

প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছাসি
উদ্ধত বিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
মুঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাপাইছে থরহরি । কেহ হতবাক,
কেহ-বা ক্রন্দণ করি ছাড়ি উর্ধ্বডাক
ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মুদি করে জপ । জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে ।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
‘বাবারে দিয়েছে ফাকি তােমাদের কেউ,
যা মেনেছে দেয় নাই,তাই এই ঢেউ
অসময়ে এ তুফান ! 'শুন এইবেলা,
করহ মানত রক্ষা, করিয়াে না খেলা।
কুদ্ধ দেবতার সনে।' যার যত ছিল।
অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল,

করি বিচার। তবু,তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুন ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্বার, ‘দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে লয়ে, এই বেলা শােন্ ।
ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিল তখনি
মােক্ষদারে লক্ষ্য করি, এই সে রমণী,
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে।
চুরি করে নিয়ে যায়!’ ‘নাও তারে ফেলে।
একবাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর।
যাত্রী সবে কহে নারী, ‘হে দাদাঠাকুর
রক্ষা করাে,রক্ষা করাে!' দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।
ভসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ,

‘আমি তাের রক্ষাকর্তা। রােষে নিশ্চেতন
মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে! |
শােধ দেবতার ঋণ সত্য ভঙ্গ করে ।
এতােগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে !'
মােক্ষদা কহিল, ‘অতি মূখ নারী আমি,
কী বলেছি রােষবশে ওগাে অন্তর্যামি,
সেই সত্য হল! সে যে মিথ্যা কতদূর।
তখনি শুনে কি তুমি বােঝনি ঠাকুর!
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা!
শােন নি কি জননীর অন্তরের কথা !
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিড়ি কাড়ি।
মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি,
দন্তে দন্ত চাপি বলে । কে তারে সহসা
মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা
দংশিল বৃশ্চিকদংশ! ‘মাসি! মাসি! মাসি!
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চিৎকারে উঠিল বিপ্র, 'রাখ! রাখ! রাখ!’
চকিতে হেরিল চাহি মূৰ্ছি আছে পড়ে
মােক্ষদা চরণে তাঁর। মুহূর্তের তরে।
ফুটন্ত তরঙ্গ-মাঝে মেলি আর্ত চোখ
‘মাসি' বলি ফুকারিয়া মিলালাে বালক
অনন্ততিমিরতলে। শুধু ক্ষীণ মুঠি,
বারেক ব্যাকুল বলে উর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
‘ফিরায়ে আনিব তােরে’-কহি উর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্ত-মাঝে ঝাপ দিল জলে ।
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে ।


০৯।  দুই বিঘা জমি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু বিঘে-দুই ছিল মাের ভুই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-
চেয়ে দেখাে মাের আছে বড়ােজোর মরিবার মতাে ঠাই।'
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানাে তাে হে, করেছি বাগান খানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা।।
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সােনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষী ছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'
পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে-
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।।
মনে ভাবিলাম, মােরে ভগবান রাখিবে না মােহগর্তে
তাই লিখে দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য-
কত হেরিলাম মনােহর ধাম, কত মনােরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি ।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরাে-ষােল,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল ।।
নমাে নমাে নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি ।

অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি—
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছােটো ছােটো গ্রামগুলি ।।
পলবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ
স্তব্ধ অতল দিঘি কালােজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে |
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে
কুমােরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখােলা নন্দীর গােলা, মন্দির করি পাছে।
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।
ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তােরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার— এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা।
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ-
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা,পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তাের লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোন চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসাে আজ, যত করাে সাজ, ছিলে দেবী-হলে দাসী।
বিদীর্নহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারিদিকে চেয়ে দেখি-
প্রাচীরের কাছে এখনাে যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক কালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভােরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন ।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে

দুটি পাকা ফল লভিল ভূ-তল আমার কোলের কাছে ।
ভাবিলাম মনে,বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা ।
হেনকালে হায় যমদূত প্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তাে নিরবে দিয়েছি আমার সব
দুটি ফল তার করি অধিকার,এত তারি কলরব।
চিনিল না মােরে, নিয়ে গেল ধ'রে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, মারিয়া করিব খুন।
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুন।।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়।
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মাের ঘটে—
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।



১০। পৃথিবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করাে, পৃথিবী
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে ।
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভােগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তােমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে ।।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র,
তােমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রুপে ;
দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর দুর্মূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
তােমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছ প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,
ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।
জলে স্থলে তােমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি-
সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘােষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।
তােমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তােরণ,
ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শােধ হয় বিনাশে।
তােমার ইতিহাসের আদি পর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়-

| সে পরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়
তার অঙ্গুলি ছিল স্থল, কলাকৌশলবর্জিত;
গদা-হাতে মুষল-হাতে লণ্ডভণ্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত ;
অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে।
জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,
প্রাণের পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।
দেবতা এলেন পরযুগে, মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের
জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।

উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট ।
নম হল শিকলে-বাঁধা দানব,
তবু সেই আদিম বর্বর আকড়ে রইল তােমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা-
তােমার স্বভাবের কালাে গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে!
তােমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি ।
দেবতার মন্ত্র উঠছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে ।।
তবু তােমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপােষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফণা তুলে।
তার তাড়নায় তােমার আপন জীবকে করছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে ।।
শুভে-অশুভে স্থাপিত তােমার পাদপীঠে
তােমার প্রচণ্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাবাে আমার ক্ষতচিহলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি।
বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্তসঞ্চার তােমার যে মাটির তলায়
তাকে আজ স্পর্শ করি -উপলদ্ধি করি সর্ব দেহে মনে।
অগণিত যুগযুগান্তরের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধূলায় ।
আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদুঃখের শেষ পরিণাম
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল-পরিচয়- গ্রাসী
নিঃশব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।
অচল অবরােধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলােকে উধাও পৃথিবী,
গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী,
নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কলমন্ত্রমুখরা পৃথিবী,
অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা।
এক দিকে আপকুধান্যভার তােমার শস্যক্ষেত্র
সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু

কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে;
অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী

‘আমি আনন্দিত।
অন্যদিকে তােমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপাণ্ডুর মরুক্ষেত্রে
পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনত্য ।
বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচথুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল
কালাে শ্যেনপাখির মতাে তােমার ঝড়
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে।
হতাশ বনস্পতি ধূলায় পড়ল উবুড় হয়ে
হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুড়ের চাল
শিকড়-ঘেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতাে।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তােমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়ছে স্বর্গীয় মদের ফেনা ;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে

অকস্মাৎ কল্লোলােচ্ছাসে ।।
স্নিগ্ধ তুমি, হিংস তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদি সৃষ্টির যহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে
সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে;
তােমার চক্ৰতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ
শত শত ভাঙা ইতিহাসের অহলুপ্ত অবশেষ;
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তােমার বর্জিত সষ্টি
অগণ্য বিস্তৃতির স্তরে স্তরে ।
জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ
তোমার বকালের ছোট ছােট পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীম, সব কীর্তির অবসান।

আজ আমি কোন মােহ নিয়ে আসিনি তােমার সম্মুখে;
এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে।
তার জন্যে অমরতার দাবি করবাে না তােমার দ্বারে।
তােমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষ গুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনাে-একটি আসনের
সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি,
জীবনের কোনাে একটি ফলবান খণ্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে
তবে দিয়াে তােমার মাটির ফোটার একটি তিলক আমার কপালে;

সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে।
যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভােলবার আগে

তােমার নিমর্ম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি ।।


১১। নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আজি এই প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান!

জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ ।।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ।
রুধিয়া রাখিতে নারি ।।
থর থর করি কাপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রােষে।
হেথায় হােথায় পাগলের প্রায়।
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়,
কোথায় কারার দ্বার ।।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাধন কেন !
ভাঙরে হৃদয়, ভাঙরে বাধন,
সাধূ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর 'পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পরে আঘাত কর ।
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
উথলি যখন উঠেছে বাসনা
জগতে তখন কিসের ডর !
আমি ঢালিব করুণাধারা
আমি ভাঙিব পাষাণকারা।

আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া

আকুল পাগল-পারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরাণ ঢালি ।
শিখর হইত শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি ।।
এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মাের,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে-প্রাণ হয়ে আছে ভাের ।
কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন, মহাসাগরের গান
ওরে, চারি দিকে মাের।
এ কী কারাগার ঘাের
ভাঙ্ ভাঙ ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাত কর।
ওরে আজ, কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।



১২। বাঁশি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কিনু গােয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লােহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর।
পথের ধারেই।
লােনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধ্বসে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে স্যাতা-পড়া দাগ।
মার্কিন-থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গনেশের
দরজার পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব।
বেতন পঁচিশ টাকা।
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে ।।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি;
আলাে জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে দশ বেজে যায় ।
তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।

ধলেশ্বরী-নদী তীরে পিসিদের গ্রাম ।
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক ।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল-
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে ।
মেয়েটা তাে রক্ষা পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তাে, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর ।
বর্ষা ঘনঘাের ।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায় ।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে, পচে ওঠে
আমের খােসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কানকা।
মরা-বেড়ালের ছানা,
ছাইপাশ আরাে কত কী যে!
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া।
মাইনের মতাে,
বহু ছিদ্র তার!
আপিসের সাজ
গােপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
বাদলের কালাে ছায়া।
স্যাৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
কলে-পড়া জন্তুর মতন।
মৃছায় অসাড়।
দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধমরা।
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

গলির মােড়েই থাকে কান্তবাবু,
যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
বড়াে বড়াে চোখ,
শৌখিন মেজাজ।।
কর্নেট বাজানাে তার শখ।
মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
এ গলির বীভৎস বাতাসে
কখনাে গভীর রাতে,
ভাের বেলা আধাে অন্ধকারে,
কখনাে বৈকালে।
ঝিকিমিকি আলােয় ছায়ায়।
হঠাৎ সন্ধ্যায়।
সিন্ধু-বারােয়ায় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে
অনাদি কালের বিরহবেদনা ।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘাের মিছে,
দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতাে।
হঠাৎ খবর পাই মনে
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনাে ভেদ নেই।
বাশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে।
এক বৈকুণ্ঠের দিকে।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গােধূলী লগ্নে
সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী;
তীরে তমালের ঘন ছায়া;
আঙ্গিনাতে
যে আছে অপেক্ষা করে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।


১৩। হঠাৎ দেখা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রেল গাড়ীর কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনােদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে
ডালিম ফুলের মতাে রাঙা ;
আজ পরেছে কালাে রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়।
দোলন-চাপার মতাে চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।
মনে হল, কালাে রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা ;
চেনা লােককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে।
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে ;
আলাপ করলেম শুরু
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার' ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছােট দুটো-একটা জবাব,
কোনােটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়-
কেন এ-সব কথ],
এর চেয়ে অনেক ভালাে চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেধিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।

এক সময় আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।
মনে হল কম সাহস নয়-
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে কিছু মনে করাে না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই,
দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনােদিনই ।।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তােমার মুখে । সত্য করে বলবে তাে ?
আমি বললেম, বলব।'
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধােল,
‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি ?
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম,
রাতের সব তারাই আছে দিনের আলাের গভীরে।।
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি !
ও বললে, “থাক, এখন যাও ওদিকে ।।
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ;
আমি চললেম একা।


১৪। সাধারণ মেয়ে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তােমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি,
শরবাবু,
‘বাসি ফুলের মালা'।
তােমার নায়িকা এলােকেশীর মরণ-
দশা ধরেছিল।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
দেখলেম তুমি মহাশয় বটে
জিতিয়ে দিলে তাকে।।
নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে
ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ
মেয়ে আমি ।।
আমার মতাে এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।
তােমাকে দোহাই দিই,
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখাে তুমি।
বড়াে দুঃখ তার ।
তারও স্বভাবের গভীরে।
অসাধারণ যদি কিছু
তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।

কাচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার নামে
কথাটা কেন উঠল তা বলি ।
মনে করাে তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল কেউ তার।
চোখে পড়েনি আমার মতাে।
এতবড়াে কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
না করব যে এমন জোর কই।
একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনাে বা ।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম! |
এত মেয়েও আছে সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!
আর তারা কি সবাই অসামান্য
এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।
আর তারা সবাই কি আবিষ্কার
করেছে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।
গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে
লিজির সঙ্গে গিয়েছিল।
সমুদ্রে নাইতে।
(বাঙালি কবির কবিতা ক’ লাইন দিয়েছে তুলে
সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে)
তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি
সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানাে নির্মল সূর্যালােক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
‘এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন
পরে যাবে চলে;
ঝিনুকের দুটি খােলা,

মাঝখানটুকু ভরা থাক
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে দুর্লভ, মূল্যহীন।'
কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।
সেই সঙ্গে নরেশ লিখেছে,
কথাগুলি যদি বানানাে হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার
হীরে-বসানাে সােনার ফুল কি সত্য, তবুও
কি সত্য নয়।'
বুঝতেই পারছ একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য
কাটার মতাে আমার বুকের
কাছে বিধিয়ে দিয়ে জানায়।
আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরাে মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগাে, নাহয় তাই হল,
নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
পায়ে পড়ি তােমার, একটা গল্প
লেখাে তুমি শরত্যাবু,
নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প।
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের
থেকে পাল্লা দিতে হয়।
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে
অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
হার হয়েছে আমার ।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে।
তাকে জিতিয়ে দিয়ে আমার হয়ে,
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।
তাকে নাম দিয়াে মালতী।
ওই নামটা আমার।

ধরা পড়বার ভয় নেই।
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে ।।
তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।
কী করে জিতিয়ে দেবে।
উচ্চ তােমার মন, তােমার
লেখনী মহীয়সী ।
তুমি হয়তাে ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,
দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতাে।
দয়া কোরাে আমাকে ।
নেমে এসাে আমার সমতলে ।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি।
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তােমার নায়িকা।
রাখাে-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম.এ. ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গণিতে হােক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।।
কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তােমার সাহিত্য সম্রাট
নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হােক
খাটো কোরাে না তােমার কল্পনা।
তুমি তাে কৃপণ নও বিধাতার মতাে।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়াে য়ুরােপে ।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান,
যারা বীর,

যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে ।
জ্যোতির্বিদের মতাে আবিষ্কার করুক ওকে
শুধু বিদুষী বলে নয়, নারী বলে ।
ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে।
ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি ।।
মালতীর সম্মানের জন্য ।
সভা ডাকা হােক-না,
বড়াে বড়াে নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ
হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো ।।
ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,
সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেছে ওর মােহিনী দৃষ্টিতে।
এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি
সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।।
বলতে হল নিজের মুখেই,
এখনাে কোনাে য়ুরােপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।।
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল ।
আর তার পরে ?
তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়ােল,
স্বপ্ন আমার ফুরােল।
হায় রে সামান্য মেয়ে!
হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!


১৫। বীরপুরুষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে করাে, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ'ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক'রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘােড়ার 'পরে
টগবগিয়ে তােমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘােড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধূলােয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধ্যে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনােখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই ।
ভয় পেয়েছ-ভাবছ, 'এলেম কোথা।'
আমি বলছি, ‘ভয় কোরাে না মা গাে,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।'
চোর কাটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।
গােরু বাছুর নেইকো কোনােখানে
সন্ধ্যে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে—
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালাে।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলাে!'
এমন সময় হারে রে রে রে রে
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!

তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবত স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলাে পাশের কাটাবনে
পালকি ছেড়ে কাপছে থরথর
আমি যেন তােমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করাে!
হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল
আমি বলি, 'দাড়া খবরদার
এক পা কাছে আসিস যদি আর
এই চেয়ে দেখ আমার তলােয়ার
টুকরাে করে দেব তােদের সেরে
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে ওঠে
চেঁচিয়ে উঠল, 'হাঁরে রে রে রে রে'
তুমি বললে, “যাস নে খােকা ওরে,
আমি বলি, 'দেখাে-না চুপ করে ।
ছুটিয়ে ঘােড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলােয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে ।
শুনে তােমার গায়ে দেবে কাটা !
কত লােক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লােকের মাথা পড়ল কাটা।
এত লােকের সঙ্গে লড়াই ক'রে,
ভাবছ খােকা গেলই বুঝি মরে ।।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে।
বলছি এসে, 'লড়াই গেছে থেমে,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে ।
চুমাে খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে।

বলছ, 'ভাগ্যে খােকা সঙ্গে ছিল’
কী দুর্দশাই হত তা না হলে!
রােজ কত কী ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না আহা ?
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে-
দাদা বলত, কেমন করে হবে,
খােকার গায়ে এত কি জোর আছে !
পাড়ার লােকে বলত শুনে,
ভাগ্যে খােকা ছিল মায়ের কাছে !


১৬। দুই পাখি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সােনার খাঁচাটিতে
মিলন হল দোঁহে,
খাঁচার পাখি ছিল।

বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া

কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,

বনেতে যাই দোঁহে মিলে ।।
খাঁচার পাখি বলে। | বনের পাখি, আয়

খাচায় থাকি নিরিবিলে ।

বনের পাখি বলে-'না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব ।

খাঁচার পাখি বলে ‘হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব ।
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি

| বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে | শিখানাে বুলি তার

দোহার ভাষা দুইমত।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,

বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,

খাঁচার গান লহাে শিখি ।
বনের পাখি বলে, না।
আমি শিখানাে গান নাহি চাই ।
খাঁচার পাখি বলে হায়, ।

আমি কেমনে বন-গান গাই ।
বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল,

কোথাও বাধা নাহি তার।
খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি

কেমন ঢাকা চারি ধার।

বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও

মেঘের মাঝে একেবারে ।
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে |

বাঁধিয়া রাখাে আপনারে!

বনের পাখি বলে না,
সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!

খাঁচার পাখি বলে ‘হায়,
মেঘে কোথায় বসিবার ঠাই!
এমনি দুই পাখি দোহারে ভালােবাসে

তবুও কাছে নাহি পায় ।।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,

নীরবে চোখে চোখে চায়।।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,

বুঝাতে নারে আপনায় ।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,

কাতরে কহে, কাছে আয়!
বনের পাখি বলে না,
কবে খাচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে হায়,
মাের শকতি নাহি উড়িবার।


১৭। লুকোচুরি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি যদি দুষ্টুমি করে

চাপার গাছে চাপা হয়ে ফুটি,
ভােরের বেলা মা গো, ডালের পরে

কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারাে,

তখন কি মা চিনতে আমায় পারাে ।।
তুমি ডাক, ‘খােকা কোথায় ওরে ।

আমি শুধু হাসি চুপটি করে ।।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে

সবই আমি দেখব নয়ন মেলে ।
সুনিটি করে চাপার তলা দিয়ে।

| আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পূজোর ঘরে যাবে,

দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে।
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে

তােমার খােকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে

বসবে 'তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে

পড়বে এসে তােমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছােট্ট ছায়াখানি

দোলাৰ তাের বইয়ের পরে আনি
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে

তােমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।

সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে।

যখন তুমি যাবে গােয়ালঘরে।
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে

টুপ করে মা, পড়ব ভুয়ে ঝরে।।
আবার আমি তােমার খােকা হব, ।

‘গল্প বলাে তােমায় গিয়ে কব।।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা।

আমি বলব, বলব না সে কথা ।


১৮। পথের বাঁধন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল।
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলাের ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।।
নাই আমাদের কনকচাপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ ।
হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণকিরণে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে।
রডােড্রেন-গুচ্ছ।
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
কৃচিৎ-কিরণে দীপ্ত।



১৯। ক্যামেলিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায় ।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।
এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরােই
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরােবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা ।।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনাে সম্বন্ধ না থাক,
ও তাে আমার সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝকঝক করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তােলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোনাে সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি
রাস্তার মধ্যে একটা কোনাে উৎপাত,
কোনাে-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।
এমন তাে আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘােলা জলের ডােবা,
বড়াে রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলাে ব্যাঙের মতাে একঘেয়ে ডাকে

সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের ।।

একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ ।।
ইচেছ করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে ।
কোনাে ছুতাে পাই নে, হাত নিশিপ করে ।
এমন সময়ে সে এক মােটা ঢুরােট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, 'ফেলাে চুরােট।'
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘােরালাে করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরােট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালাে কটমট করে
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল ।
বােধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গােছের নাম ।।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার ।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, “বেশ করেছেন মশায়। '
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে ।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুবলুম, ভুল করেছি গোয়ারের মতাে।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে শোনাে দরকারই ছিল না।

আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডােবা।
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতাে।
ঠিক করলুম ভুল শােধরাতে হবে।
খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার ।
ওদের ছােট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে।
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শােনা গেল আসবে না এবার ।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মােহনলাল
রােগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায় ।
সে বললে, 'তনুকা আমার বােন,
কিছুতে ছাড়বে না তােমার সঙ্গে দেখা না করে। '
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু
যতটা পড়াশােনায় ঝোক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ‘পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি
মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
‘একটি জিনিস দেব আপনাকে যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা।
একটি ফুলের গাছ।'
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।।
তনুকা বললে, 'দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।

জিজ্ঞেস করলেম, ‘নামটা কী?'
সে বললে 'ক্যামেলিয়া'।
চমক লাগল
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে ।।
হেসে বললেম, ‘ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।'
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুশিও হল।।
চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে ।।
দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয় ।।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে ।
থাক এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরাে মাস কয়েকের তুচ্ছতা।।
পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল।
সাঁওতাল পরগনায় ।
জায়গাটা ছােটো। নাম বলতে চাই নে।
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন ।
শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায় ।।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়।
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তঁাবু পাতলেম নদীর ধারে ।।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া ।।

কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রােদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে ।
মেঠো ফুলগুলাে পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে ।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ও পারে,
সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।
একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর ওদের চড়িভাতি।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি,
আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই?
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে,
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগােছের ভালুকও কি মেলে না?
দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক
শটু-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে হাভানা চুরােট খাচেছ ।
আর, কমলা অন্যমনে টুকরাে টুকরাে করছে
একটা শ্বেত জবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে।
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতে, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
অর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটাবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।

সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগােল কত দূর ।।
সময় হয়েছে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ।
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব ।
শালপাতার পাত্রে ।
তাবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প ।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, বাবু, ডেকেছিস কেনে ।
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাওতাল মেয়ের কানে
কালাে গালের উপর আলাে করেছে।
সে আবার জিজ্ঞেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে । '
আমি বললেম, এইজন্যেই। '
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।।


২০। ঝুলন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে

মরণখেলা

নিশীথবেলা ।।
সঘন বরষা, গগন আঁধার,
হেরাে বারিধারে কাঁদে চারি ধার,
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে

ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন-শয়ন

করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা ।
ওগাে, পবনে গগনে সাগরে আজিকে

কী কল্লোল,

দে দোল দোল্ ।।
পশ্চাৎ হতে হা হা করে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর

অট্টরােল ।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে

হট্টগোল ।
দে দোল দোল ।
আজি
জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার

বসিয়া আছে

বুকের কাছে।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাপিয়া,
ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,

নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে

হৃদয় নাচে;
ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার

ব্যাকুলিয়াছে।
বুকের কাছে।
হায়, এতকাল আমি রেখেছিনু তারে

যতনভরে।

শয়ন'-পরে।
ব্যথা পাছে লাগে দুখ পাছে জাগে।
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে।
বাসরশয়ন করেছি রচন।

কুসুম-থরে ;
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে

গােপন ঘরে
যতনভরে ।।
কত সােহাগ করেছি চুম্বন করি

নয়নপাতে

স্নেহের সাথে ।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয় নাম মৃদু মধুভাষে,
গুগুরতান করিয়াছি গান।

জ্যোৎস্নারাতে।
যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার

দুখানি হাতে
স্নেহের সাথে ।
শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান

আলস-রসে
আবেশবশে।।

পরশ করিলে জাগে না সে আর,
কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার

নিশিদিবসে ।।
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ

মরমে পশে
আবেশৰশে।
ঢালি মধুরে মধুর বধূরে আমার

হারাই বুঝি,

পাই নে খুঁজি।
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে
ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম

হয়েছে পুঁজি !
অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া

মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি।
তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে।

নূতন খেলা।

রাত্রিবেলা।
মরণদোলায় ধরি রশিগছি।
বসিব দুজনে বড়াে কাছাকাছি,
ঝঞা আসিয়া অট্ট হাসিয়া

মারিবে ঠেলা ।
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে

ঝুলনখেলা
নিশীখবো ।।
দে দােল দোল্ ।
দে দে দোল ।

এ মহাসাগরে তুফান তাে ।
বধূরে আমার পেয়েছি আবার

ভরেছে কোল।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে।

প্রলয়রােল।
বক্ষ-শােণিতে উঠেছে আবার

কী হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার

কী কল্লোল!
উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,
উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী

মত্ত-বােল।।

দে দোল দোল।
আয় রে ঝা, পরান-বধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-

বসন খােল।

দে দোল দোল্ ।
প্রাণেতে আমাতে মুখােমুখি আজ
চিনি লব দেহে ছাড়ি ভয়-লাজ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব দেহে
ভাবে বিভােল ।।

দে দোল দোল্ ।।
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ

দুটো পাগল ।
দে দোল দোল ।

অন্য মা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার মা না হয়ে তুমি

আর-কারাে মা হলে
ভাবছ তােমায় চিনতেম না,

যেতেম না ঐ কোলে ?
মজা আরো হত ভারি,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে,

তুমি পারের গায়ে ।
এইখানেতেই দিনের বেলা
যা-কিছু সব হত খেলা।
দিন ফুরােলেই তােমার কাছে

| পেরিয়ে যেতে নায়ে।।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতে, ‘ব দেখি কে ?
তুমি ভাবতে, চেনার মতো।

| চিনি নে তাে তবু।।
তখন কোলে ঝাপিয়ে পড়ে
আমি বলতে গলা ধরে ।
‘আমায় তােমার চিনতে হবেই,

| আমি তােমার অবু!'
ঐ পারেতে যখন তুমি।

আনতে যেতে জল,
এই পারেতে তখন ঘাটে।

বল দেখি কে বল ?
কাগজ-গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তােমার দিকে,
যদি গিয়ে পৌঁছােত সে

বুঝতে কি, সে কার ?

সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে,
আমার পারের থেকে আমি

যেতেম তোমার পার ।।
মায়ের পারে অরুর পারে।
থাকত তফাত, কেউ তাে কারে।
ধরতে গিয়ে পেত নাকো,

| রইত না একসাথে ।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা-দেখি দূরে দূরে।
সন্ধেবেলায় মিলে যেত

অবুতে আর মাতে।
কিন্তু হঠাৎ কোনােদিনে ।

যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তােমার পারে।

নাই হত মা রাজি
যারে তােমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের পরে মাদুর মেলে।
বসতে তুমি, পায়ের কাছে

বসত গান্তবুড়ি,
উঠত তারা সাত ভয়েতে,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে,
উড়ো ছায়ার মতাে বাদুড়

কোথায় যেত উড়ি।
তখন কি মা, দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে।
পার হয়ে মা, আসতে হতই

অবু যেথায় আছে।
তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার

অবুর পরের কাছে ।

দুয়ােরানী ইচ্ছে করে, মা, যদি তুই

হতিস দুয়ােরানী !
ছেড়ে দিতে এমনি কি ভয়

তােমার এ ঘরখানি।
ওইখানে ওই পুকুরপারে।
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
ও যেন ঘাের বনের মধ্যে

কেউ কোথাও নেই।
ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাধব তােমার ছােট্ট কুঁড়ে,
শুকনাে পাতা বিছিয়ে ঘরে

থাকব দুজনেই।
বাঘ ভালুক অনেক আছে,
আসবে না কেউ তােমার কাছে,
দিনরাত্তির কোমর বেঁধে ।

থাকব পাহারাতে।
রাক্ষসেরা ঝােপে ঝাড়ে
মারবে উকি আড়ে আড়ে,
দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি

ধনুক নিয়ে হাতে ।
আঁচলেতে খই নিয়ে তুই।

যেই দাঁড়াবি দ্বারে।
অমনি যত বনের হরিণ

আসবে সারে সারে।
শিঙগুলি সব আঁকাবাঁকা,
গায়েতে দাগ চাকা চাকা,
লুটিয়ে তারা পড়বে ভুয়ে

পায়ের কাছে এসে।
ওরা সবাই আমায় বােঝে,
করবে না ভয় একটুও যে,
হাত বুলিয়ে দেব গায়ে,

বসবে কাছে ঘেঁষে।

ফলসা-বনে গাছে গাছে।
ফল ধরে মেঘ করে আছে,
ওইখানেতে ময়ূর এসে

নাচ দেখিয়ে যাবে।
শালিখরা সব মিছিমিছি।
লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি,
কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে।

হাত থেকে ধান খাবে।
দিন ফুরােবে, সাঁঝের আঁধার

নামবে তালের গাছে।।
তখন এসে ঘরের কোণে।

বসব কোলের কাছে।
থাকবে না তাের কাজ কিছু তাে,
রইবে না তাের কোনাে ছুতাে,
রূপকথা তাের বলতে হবে

রােজই নতুন করে ।
সীতার বনবাসের ছড়া
সবগুলি তাের আছে পড়া ;
সুর করে তাই আগাগােড়া

গাইতে হবে তােরে ।
তার পরে যেই অশথবনে।
ডাকবে পেঁচা, আমার মনে।
একটুখানি ভয় করবে ।

রাত্রি নিশুত হলে ।
তােমার বুকে মুখটি খুঁজে
ঘুমেতে চোখ আসবে বুজে
তখন আবার বাবার কাছে।

যাস নে যেন চলে !



২১। বাশিওআলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘ওগাে বাঁশিওআলা,
বাজাও তােমার বাঁশি,

শুনি আমার নূতন নাম’
এই বলে তােমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,

মনে আছে তাে ?
আমি তােমার বাংলাদেশের মেয়ে।
সৃষ্টিকর্তা পুরাে সময় দেন নি।
আমাকে মানুষ করে গড়তে

রেখেছেন আধাআধি করে।
অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি।
সেকালে আর আজকের কালে,
মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,

মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়।
আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকোয়,
চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন।
কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায় ।

সেখান থেকে দেখি ।
প্রখর আলােয় ঝাপসা দূরের জগৎ
বিনা কারণে কাঙাল মন অধীর হয়ে ওঠে,
দুই হাত বাড়িয়ে দিই,

নাগাল পাই নে কিছুই কোনাে দিকে ।
বেলা তাে কাটে না,
বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে
ভেসে যায় মুক্তি-পারের খেয়া,
ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা,

ভেসে যায় চলিত বেলার আলােছায়া।


এমন সময় বাজে তােমার বাশি

ভরা জীবনের সুরে ।
মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে।

দবদবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ ।
কী বাজাও তুমি,
জানি নে সে সুর জাগায় কার মনে কী ব্যথা।

বুঝি বাজাও পঞ্চমুরাগে।
দক্ষিণ হাওয়ার নবযৌবনের ভাটিয়ারি ।
শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়।
যে ছিল পাহাড়তলির ঝিঝিরে নদী,
তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে

শ্রাবণের বাদলরাত্রি।
সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে,
একগুয়ে পাথরগুলােকে ঠেলা দিচ্ছে।

অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণি-মাতন।
আমার রক্তে নিয়ে আসে তােমার সুর
ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক, আগুনের ডাক,
পাজরের উপরে আছাড়-খাওয়া

মরণ-সাগরের ডাক,
ঘরের শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক।
যেন হাঁক দিয়ে আসে
অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে

পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি,
ছিনিয়ে নেবে, ভাসিয়ে দেবে বুঝি।
অঙ্গে অঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে।

কালবৈশাখীর ঘূর্ণি-মার-খাওয়া

অরণ্যের বকুনি ।
ডানা দেয় নি বিধাতা,
তােমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে!

ঝােড়াে আকাশে উড়াে প্রাণের পাগলামি ।।


ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে ;
সবাই বলে ভালাে'।
তারা দেখে আমার ইচছার নেই জোর,

সাড়া নেই লােভের,
ঝাপট লাগে মাথার উপর,

| ধুলােয় লুটোই মাথা।।
দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত করে ফেলি

নেই এমন বুকের পাটা ;
কঠিন করে জানি নে ভালােবাসতে,

| কাদতে শুধু জানি,
জানি এলিয়ে পড়তে পারে ।
বাঁশিওআলা,
বেজে ওঠে তােমার বাঁশি
ডাক পড়ে অমর্তলােকে ;
সেখানে আপন গরিমায়

উপরে উঠেছে আমার মাথা ।
সেখানে কুয়াশার পর্দা-ছেড়া

তরুণ-সূর্য আমার জীবন ।
সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয়।

আমার বারণ-না-মানা আগ্রহ,
উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে।
প্রথম-ক্ষুধায়-অস্থির গরুড়ের মতাে।

| জেগে ওঠে বিদ্রোহিণী ;
তীক্ষ্ম চোখের আড়ে জানায় ঘৃণা

চার দিকের ভীরুর ভিড়কে,
কৃষ্ণ কুটিলের কাপুরুষতাকে
বাঁশিওআলা,
হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি ।

জানি নে ঠিক জায়গাটি কোথায়,

ঠিক সময় কখন,

চিনবে কেমন করে ।
দোসর-হারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝনক রাত্রে

| সেই নারী তাে ছায়ারূপে
গেছে তােমার অভিসারে চোখ-এড়ানাে পথে ।
সেই অজানাকে কত বসন্তে।

পরিয়েছ ছন্দের মালা,
শুকোবে না তার ফুল ।।
তােমার ডাক শুনে একদিন
ঘরপােষা নির্জীব মেয়ে।

অন্ধকার কোণ থেকে
বেরিয়ে এল ঘােমটা-খসা নারী।
যেন সে হঠাৎ-গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির,

চমক লাগালাে তােমাকেই।
সে নামবে না গানের আসন থেকে ;
| সে লিখবে তােমাকে চিঠি
রাগিণীর আবছায়ায় বসে।
তুমি জানবে না তার ঠিকানা।
ওগাে বাঁশিওআলা,
সে থাক্‌ তােমার বাঁশির সুরের দূরত্বে।


২২। আফ্রিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদ্বান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে।
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা-নাভার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তােমাকে, আফ্রিকা,
বাঁধলে তােমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলাের অন্তঃপুরে !
সেখানে নিভূত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল তােমার চেতনাতীত মনে ।।
বিদ্রুপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উৎ' করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে ।
হায় ছায়াবৃতা,
কালাে ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তােমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে !
এল ওরা লােহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তােমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তােমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে ।
সভ্যের বর্বর লােভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষ ।

তােমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তােমার রক্তে অশ্রুতে মিশে;
দস্যু-পায়ের কাটা-মারা জুতাের তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড ।
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তােমার অপমানিত ইতিহাসে ।
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পুজোর ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল।
সুন্দরের আরাধনা ।
আজ যখন পশ্চিমদিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্তগহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল,
অশুভ ধ্বনিতে ঘােষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসাে যুগান্তরের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে,
বলাে ‘ক্ষমা করাে
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হােক তােমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।



২৩। সন্ধ্যা ও প্রভাত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এখানে নামল সন্ধ্যা।
সূর্যদেব,
কোন দেশে, কোন সমুদ্রপারে,
তােমার প্রভাত হল ।
অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা,
বাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নববধুর মতাে;
কোনখানে ফুটল ভােরবেলাকার কনকচাপা।
জাগল কে ।।
নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানাে দীপ,
ফেলে দিল রাত্রে-গাঁথা সেঁউতিফুলের মালা ।
এখানে একে একে দরজায় আগল পড়ল,
সেখানে জানলা গেল খুলে ।
এখানে নৌকো ঘাটে বাঁধা,
মাঝি ঘুমিয়ে;
সেখানে পালে লেগেছে হাওয়া।
ওরা পান্থশালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে,
পুবের দিকে মুখ করে চলেছে।
ওদের কপালে লেগেছে সকালের আলাে,
ওদের পারানির কড়ি এখনাে ফুরােয় নি;
ওদের জন্যে পথের ধারের জানলায় জানলায়
কালাে চোখের করুণ কামনা অনিমেষ চেয়ে আছে:
রাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে,
বললে, 'তােমাদের জন্যে সব প্রস্তুত।'
ওদের হৃৎপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরী বেজে উঠল।
এখানে সবাই ধূসর আলােয় দিনের শেষ খেয়া পার হল ।
পান্থশালার আঙিনায় এরা কাথা বিছিয়েছে;
কেউ বা একলা, কারাে বা সঙ্গী ক্লান্ত;
সামনের পথে কী আছে অন্ধকারে দেখা গেল না,

পিছনের পথে কী ছিল কানে কানে বলাবলি করছে;
বলতে বলতে কথা বেধে যায়,
তার পরে চুপ করে থাকে;
তার পরে আঙিনা থেকে উপরে চেয়ে দেখে,
আকাশে উঠেছে সপ্তর্ষি ।
সূর্যদেব,
তােমার বামে এই সন্ধ্যা,
তােমার দক্ষিণে ঐ প্রভাত, এদের তুমি মিলিয়ে দাও।
এর ছায়া ওর আলােটিকে একবার কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করুক,
এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক।


২৪। অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তােমারেই যেন ভালােবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়।
গাথিয়াছে গীতহার
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমির রজনী ভেদিয়া তােমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তােমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি
সকল কালের সকল কবির গীতি ।

নয়ন তােমারে পায় না দেখিতে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নয়ন তােমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তােমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গােপনে।
বাসনা বশে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতাে।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে সতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে ।।
সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ।
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।
তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর।
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।।
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতাে পাই তােমায় আরাে ততাে যাচি
যতাে জানি ততাে জানি নে ।
জানি আমি তােমায় পাবাে নিরন্তন
লােক লােকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনাে বাধা নাই ভুবনে।
নয়ন তােমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।।


২৫। বর্ষামঙ্গল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিথিত ক্ষিতিসৌরভ-ভরসে।
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর-সরসা।।
গুরুগর্জনে নীপমঞ্জরী শিহরে,
শিখী দম্পতী কেকাকল্লোরে বিহরে ।
দিগধূচিত হরষা।
ঘনগৌরবে আসে উন্মাদ বরষা।
কোথা তােরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,
জনপদবধ কিঙ্কিণীকলকলনা,
মালতী মালিনী কোথা প্রিয় পরিচারিকা,
কোথা তােরা অভিসারিকা!
ঘনবনতলে এসাে ঘননীলবসনা,
ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণ রসনা,
আনাে বীণা মনােহারিকা।
কোথা বিরহিণী, কোথা তােরা অভিসারিকা!
আনাে মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা,
বাজাও শখ, হুলুরব করাে বধূরা।
এসেছে বরষা, ওগাে নব-অনুরাগিণী,
ওগাে প্রিয়সুখভাগিনী!
কুঙ্কুটিরে, অয়ি ভাবাকুললােচনা,
ভূর্জপাতায় নব গীত করাে রচনা
মেঘমল্লার-রাগিণী।।
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী!
কেতকীকেশরে কেশপাশ করাে সুরভি,
মরীণ কটিতটে গাথি লয়ে পরাে করবী,
কদম্বরে বিছাইয়া দাও শয়নে।
অঞ্জন আঁকো নয়নে।

তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া
ভবনশিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া
স্মিতবিকশিত বয়নে
কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে।
স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে;
শশীতারাহীনা অন্ধতামসী যামিনী
কোথা তােরা পুরকামিনী !
আজিকে দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে,
জনহীন পথ কাঁদিছে ক্ষুব্ধ পবনে,
চমকে দীপ্ত দামিনী।
শূন্যশয়নে কোথা জাগে পুরকামিনী!
যূথীপরিমল আসিছে সজল সমীরে,
ডাকিছে দাদুরী তমালকুতিমিরে
জাগাে সহচরী, আজিকার নিশি ভুলাে না,
নীপশাখে বাঁধাে ঝুলনা।
কুসুমপরাগ ঝরিবে ঝলকে ঝলকে,
অধরে অধরে মিলন অলকে অলকে,
কোথা পুলকের তুলনা!
নীপশাখে, সখী, ফুলডােরে বাঁধাে ঝুলনা।
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা।
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা ।।
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা ।
শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা।


২৬। সােনার তরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা ।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছােটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।।
পরপারে দেখি আঁকা।
তরুছায়ামসীমাখা।
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাতবেলা।
এ পারেতে ছােটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনাে দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু-ধারে।
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগাে, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়াে যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
'শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে
আমার সােনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-'পরে।

আর আছে ? আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে।
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাই নাই, ঠাই নাই ছােটো সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।


২৭। আশা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মস্ত যে-সব কাণ্ড করি, শক্ত তেমন নয়;
জগৎ-হিতের তরে ফিরি বিশ্বজগৎময়।
সঙ্গীর ভিড় বেড়ে চলে; অনেক লেখাপড়া,
অনেক ভাষায় বকাবকি, অনেক ভাঙাগড়া ।
ক্রমে ক্রমে জাল গেঁথে যায়, গিঠের পরে গিঠ
মহল-'পরে মহল ওঠে, ইটের ‘পরে ইট ।
কীৰ্তিরে কেউ ভালাে বলে, মন্দ বলে কেহ;
বিশ্বাসে কেউ কাছে আসে, কেউ করে সন্দেহ।
কিছু খাটি, কিছু ভেজাল, মসলা যেমন জোটে,
মােটের পরে একটা কিছু হয়ে ওঠেই ওঠে।
কিন্তু যে-সব ছােটো আশা করুণ অতিশয়,
সহজ বটে শুনতে লাগে, মােটেই সহজ নয়।
একটুকু সুখ গানের সুরে ফুলের গন্ধে মেশা
গাছের-ছায়ায়-স্বপ্ন-দেখা অবকাশের নেশা,
মনে ভাবি, চাইলে পাব; যখন তারে চাহি,
তখন দেখি চঞ্চলা সে কোনােখানেই নাহি ।
অরূপ অকূল বাষ্পমাঝে বিধি কোমর বেঁধে
আকাশটারে কাপিয়ে যখন সৃষ্টি দিলেন কেঁদে
আদ্যযুগের খাটুনিতে পাহাড় হল উচ্চ ।
লক্ষযুগের স্বপ্নে পেলেন প্রথম ফুলের গুচ্ছ।
বহুদিন মনে ছিল আশা

ধরণীর এক কোণে

রহিব আপন-মনে;
ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা।

করেছিনু আশা।
গাছটির স্নিগ্ধ ছায়া নদীটির ধারা,

ঘরে-আনা গােধূলিতে সন্ধ্যাটির তারা,
চামেলির গন্ধটুকু জানালার ধারে,
ভােরের প্রথম আলাে জলের ওপারে ।

তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

ভরিয়া তুলিব ধীরে
জীবনের কদিনের কাদা আর হাসা ।
ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা

করেছিনু আশা।
বহুদিন মনে ছিল আশা

অন্তরের ধ্যানখানি

লভিবে সম্পূর্ণ বাণী;
ধন নয়, মান নয়, আপনার ভাষা

করেছিন আশা।
মেঘে মেঘে এঁকে যায় অস্তগামী রবি
কল্পনার শেষ রঙে সমাপ্তির ছবি,
আপন স্বপনলােক আলােকে ছায়ায়।
রঙে রসে রচি দিব তেমনি মায়ায়।

তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

ভরিয়া তুলিব ধীরে
জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা;
ধন নয়, মান নয়, ধেয়ানের ভাষা।

করেছিনু আশা ।
বহুদিন মনে ছিল আশা
প্রাণের গভীর ক্ষুধা

পাবে তার শেষ সুধা;
ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালােবাসা।

করেছিনু আশা।
হৃদয়ের সুর দিয়ে নামটুকু ডাকা,
অকারণে কাছে এসে হাতে হাত রাখা,

দরে গেলে একা বসে মনে মনে ভাবা,
কাছে এলে দুই চোখে কথা-ভরা আভা ।

তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

ভরিয়া তুলিব ধীরে।
জীবনের কদিনের কাদা আর হাসা;
ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালােবাসা।

করেছিনু আশা।



২৮। ইচ্ছামতী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখন যেমন মনে করি

তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই

ইচ্ছামতী নদী।
রইবে আমার দখিন ধারে

সূর্য ওঠার পার,
বায়ের ধারে সন্ধেবেলায়।

নামবে অন্ধকার ।।
আমি কইব মনের কথা

| দুই পারেরই সাথে,
আধেক কথা দিনের বেলায়,

আধেক কথা রাতে।
যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই

| আপন গায়ের ঘাটে
ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই

দূরের মাঠে মাঠে।
গাঁয়ের মানুষ চিনি, যারা।

নাইতে আসে জলে,
গােরু মহিষ নিয়ে যারা

সাঁতরে ওপার চলে।
দূরের মানুষ যারা তাদের

নতুনতরাে বেশ,
নাম জানি নে, গ্রাম জানি নে।

অদ্ভুতের একশেষ।
জলের উপর ঝলােমলাে

টুকরাে আলাের রাশি।

ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন,

হাততালি আর হাসি।
নিচের তলায় তলিয়ে যেথায়

গেছে ঘাটের ধাপ
সেইখানেতে কারা সবাই

রয়েছে চুপচাপ ।
কোণে কোণে আপন মনে।

করছে তারা কী কে।
আমারই ভয় করবে কেমন

তাকাতে সেই দিকে।
গাঁয়ের লােকে চিনবে আমার

কেবল একটুখানি ।
বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে।

| আমিই সে কি জানি ?
একধারেতে মাঠে ঘাটে

সবুজ বরন শুধু,
আর এক ধারে বালুর চরে

রৌদ্র করে ধূ ধূ।
দিনের বেলায় যাওয়া আসা,

রাত্তিরে থম্ থম্ !
ডাঙার পানে চেয়ে চেয়ে।

করবে গা ছম ছম্‌।


২৯। স্বপ্ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দূরে বহুদূরে।
স্বপ্নলােকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছি কবে শিপ্রানদীপারে
মাের পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়ারে ।
মুখে তার লােরেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমলে কুকলি, কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাধা,
চরণে নুপুরখানি বাজে আধা আধা ।
বসন্তের দিনে ।
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে।
মহাকালমন্দিরের মাঝে।
তখন গম্ভীর মন্ত্রে সন্ধ্যারতি বাজে।।
জনশূন্য পণ্যবীথি উধ্বে যায় দেখা
অন্ধকার হম-'পরে সন্ধ্যারশিরেখা ।
প্রিয়ার ভবন
বঙ্কিম সংকীর্ণ পথে দুর্গম, নির্জন ।
দ্বারে আঁকা শঙ্খচক্র, তারি দুই ধারে
দুটি শিশু নীপতরু পুত্রস্নেহে বাড়ে।
তােরণের শ্বেতস্তম্ভ-'পরে
সিংহের গম্ভীর মূর্তি বসি দম্ভভরে ।
প্রিয়ার কপােতগুলি ফিরে এল ঘরে,
ময়ুর দ্রিায় মগ্ন স্বর্ণদণ্ড-'পরে।।
হেনকালে হাতে দীপশিখা
ধীরে ধীরে নামি এল মাের মালবিকা।
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সােপানের পরে
সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতাে সন্ধ্যাতারা করে।
অঙ্গের কুস্তুমগন্ধ কেশধূপবাস।
ফেলিল সর্বাঙ্গে মাের উতলা নিশ্বাস ।

প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন-অন্তরে
চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়ােধরে ।
দাড়াইল প্রতিমার প্রায়।
নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় ।
মােরে হেরি প্রিয়া
ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া
আইল সম্মুখে, মাের হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধালাে শুধু, সকরুণ আঁখি,
দহে বন্ধু, আছ তাে ভালাে ?' মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু কথা আর নাহি ।
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি নাম দোহাকার
দুজনে ভাবিনু কত মনে নাহি আর।।
দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোহা-পানে,
অঝােরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে ।
দুজনে ভাবিনু কত দ্বারতরুতলে।
নাহি জানি কখন কী ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণকরে, কুলায়প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতাে; মুখখানি তার
নতবৃন্তপদ্মসম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে; ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস ।
রজনীর অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার।
দীপ দ্বারপাশে।
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে।
শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে।

Post a Comment

0 Comments